রক্তশূন্যতা দূর করার ঘরোয়া উপায় জেনে নিন।
রক্তশূন্যতা দূর করার ঘরোয়া উপায় জানা আমাদের দরকার। রক্তস্বল্পতা এটি যে কারো হতে পারে। তবে শিশুদের ক্ষেত্রে এটি বেশি দেখা যায়। রক্তস্বল্পতা বলতে অনেকে মনে করেন শরীরের রক্ত নেই। ব্যাপারটা কিন্তু তা না। সাধারণত রক্তশূন্যতা বলতে বুঝায় রক্তে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা কমে যাওয়া।
যার ফলে রক্তে লোহিত কণিকার পরিমান কম থাকে। একটি শিশুর বয়স বা বেড়ে ওঠার তুলনায় যদি রক্তে হিমোগ্লোবিনের স্তর কম থাকে তাকে রক্তশূন্যতা বলা হয়।
বাংলাদেশের শিশুদের মধ্যে এনিমিয়া (রক্তশূন্যতা) হওয়ার প্রবণতা একটু বেশি। হিমোগ্লোবিনের কাজ হচ্ছে রক্তে অক্সিজেন সরবরাহ করা। কোন শিশুর রক্তে যদি এই গুরুত্বপূর্ণ উপাদানটি কম থাকে তাহলে বিভিন্ন ধরনের আনুষাঙ্গিক উপসর্গ দেখা দিতে পারে।
হিমোগ্লোবিনের অভাবে মস্তিস্কের জটিলতা বেশি দেখা যায়। বিশেষ করে মস্তিস্কে অক্সিজেনের পরিমাণ কমে গেলে শিশুর মধ্যে বেশ কিছু পরিবর্তন দেখা দিতে পারে যেমনঃ
- খিটখিটে স্বভাব
- কর্মস্পৃহা কমে যাওয়া
- ক্লাসে অমনোযোগি ইত্যাদি।
প্রাপ্ত বয়স্কদের রক্তশূন্যতাঃ
রক্তশূন্যতা যে সুধু মাত্র শিশুদের দেখা যায় তা নয়। এটি যে কারো হতে পারে। তবে আমাদের দেশে পুরুষদের তুলণায় নারীরা বেশি এই সমস্যায় ভোগেন। রক্তস্বল্পতার প্রভাবে শরীরের রং ফ্যাকাসে হয়ে যায়, খাবারে অনিহা তৈরি হয় ইত্যাদি। যেসব কারণে রক্তস্বল্পতা দেখা দেয়।
ভিটামিনের ঘাটতিঃ
প্রয়োজনের তুলনায় মাছ, মাংস কম খেলে দেহে ভিটামিন 12 ঘাটতি দেখা দেয়। যার ফলে শরীরে রেড ব্লাড সেল উৎপাদনে অক্ষম হয়। যা থেকে দেখা দিতে পারে এনিমিয়া বা রক্তস্বল্পতা।
আয়রনের অভাবঃ
আয়রনের অভাবেও শরীরের রক্তশূন্যতা দেখা দিতে পারে। বিশেষ করে খাদ্য তালিকায় পর্যাপ্ত আয়রনের সরবরাহ না থাকা। আয়রনের অভাবে দেহে রেড ব্লাড সেলের জন্য পর্যাপ্ত হিমোগ্লোবিন তৈরি করতে পারে না। যার ফলে শরীরে এনিমিয়া বা রক্তস্বল্পতার মতো সমস্যার সৃষ্টি হয়। এছাড়াও অত্যাধিক মাত্রায় ক্যাফেইন গ্রহণ বা ঘনঘন রক্তদান শরীরে আয়রনের পরিমাণ কমিয়ে দেয়।
রক্তশূন্যতা দূর করার ঘরোয়া উপায়
রক্তশূন্যতা থেকে বাঁচতে ভিটামিন যুক্ত খাবারের কোন বিকল্প নেই। নিয়মিত ও পরিমিত খাবার আপনার স্বাস্থ্যকে সুস্থ রাখতে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। রক্তস্বল্পতা থেকে বাঁচতে যে সকল খাবার খাওয়া উচিতঃ-
- ভিটামিন সি যুক্ত খাবার গ্রহণ করুন যেমনঃ টক বা টকজাতীয় ফল লেবু, আনারস, টমেটো, কামরাঙ্গা, চালতে ইত্যাদি ভিটামিন সি এর ভালো উৎস। ভিটামিন সি খাদ্য থেকে শক্তি শোষণে সহায্য করে। ফলে রক্তস্বল্পতার প্রবণতা কমে যায়।
- আয়রনঃ রক্তস্বল্পতা দূর করতে আয়রনের ভূমিকা অপরিসীম। খাদ্য তালিকা আয়রন যুক্ত খাবার যেমনঃ মাছ, মাংস, কলিজা, ডিম, দুধ, বাদাম ও সবুজ শাক-সবজি রাখতে পারেন।
- যাদের শরীরে রক্তস্বল্পতা আছে তারা চা, কফি ও রেড ওয়াইন জাতীয় পানীয় এড়িয়ে চলুন। কেননা এগুলো শরীরে আয়রন শোষণে বাঁধা দেয়। তাই এগুলো পরিহার করাই উত্তম।
- আয়রন, মেঙ্গানিজ, কপার আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য খুবই উপকারী যেটি আপনি মধুতে পাবেন। প্রতিদিন ১ চা চামচ মধু ও এক চা চামচ ভিনেগার এক গ্লাস পানিতে মিশিয়ে পান করার অভ্যাস করুন।
- কলা ও মধুতে প্রচুর পরিমানে আয়রন পাওয়া যায়। প্রতিদিন একটি কলা ও মধুকে মিশিয়ে জুস তৈরি করে পান করুন। অথবা দুটা আলাদা আলাদা করেও খেতে পারেন। এটিও রক্তস্বল্পতা দূর করতে অনেকটা সাহায্য করবে।
- রক্তস্বল্পতা দূর করতে কলিজা ও দুধ খেতে পারেন। কলিজায় প্রচুর পরিমাণ ভিটামিন বি ও আয়রন রয়েছে। তাই সম্ভব হলে প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় কলিজা রাখুন।
- অন্যদিকে দুধের মধ্যে রয়েছে প্রোটিন, ক্যালসিয়াম ও পটাশিয়াম যা শরীরের গুরুত্বপূর্ণ শক্তির যোগান দিবে এবং হিমোগ্লোবিনের মাত্রা বাড়িয়ে তুলবে ফলে খুব দ্রুত রক্তস্বল্পতা থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যাবে।
- খেজুরে প্রচুর পরিমাণে আয়রন রযেছে। তাই প্রতিদিনকার খাদ্য তালিকায় ৫ থেকে ৭ টি খেজুর রাখার চেষ্টা করুন।
- ফোলেট রক্তে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা ঠিক রাখতে সাহায্য করে। যেটি আপনি সব রকমের ডালে পেয়ে যাবেন। তাই খাদ্য তালিকায় মসুর, মুগ কিংবা মাসকলাইয়ের ডাল রাখতে পারেন।
শিশুর বৃদ্ধিতে রক্তস্বল্পতার প্রভাবঃ
শিশুদের দৈহিক ও মানসিক বৃদ্ধির জন্য দেহে অক্সিজেনের মাত্রা ঠিক রাখা অত্যান্ত জরুরি যেটি হিমোগ্লোবিনের মাধ্যমে সঞ্চালিত হয়। কোন শিশুর দেহে যদি হিমোগ্লোবিনের মাত্র ঠিক না থাকে তাহলে সেটি তার স্বাভাবিক বৃদ্ধিকে ব্যাহত করবে।
কিভাবে বুঝবেন আপনার শিশু রক্তশূন্যতায় ভুগছে কিনা?
রক্তশূন্যতার ফলে শিশুদের মধ্যে স্বাভাবিকভাবে যেই পরিবর্তনটি দেখা যায় সেটি হলো গায়ের রং ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়া। যেটাকে দেখে মনে হতে পারে শিশুটি ফর্সা হচ্ছে। আসলে সেটা নয়। এছাড়াও রক্তস্বল্পতা ফলে শিশুদের আচরণগত কিছু পরিবর্তন দেখা যায় যেমনঃ কর্মচঞ্চলতা কমে যাওয়া, খেলাধুলার প্রতি অনিহা, অস্বাভাবিক খাবার গ্রহণ, খিটখিটে প্রকৃতির ইত্যাদি।
আবার কোন কোন সময় এ ধরণের শিশুরা হাতের কাছে থাকা বস্তুর প্রতি আকৃষ্ট হয় এবং সেগুলো মুখে তুলে নেয় যেমনঃ হাতের কাছে থাকা কাগজ বা দেয়ালের রং ইত্যাদি। শিশুদের মধ্যেও এমন অস্বাভাবিক পরিবর্তন আসলে বুঝতে হবে আপনার শিশুটি এনিমিয়ায় বা রক্তস্বল্পতা ভুগছে।
শিশুদের রক্তে হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ একেবারে কমে গেলে শ্বাসকষ্ট দেখা দিবে। এমনকি এনিমিয়া বা রক্তশূন্যতার প্রভাবে তাদের হার্ট ফেইলিউর পর্যন্ত হতে পারে। তাই এ সময় দেরি না করে দ্রুত একজন বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হওয়া অত্যন্ত জরুরী।
শিশুদের রক্তশূন্যতার কারণ কি?
শিশু ভূমিষ্ঠ হওয়ার আগ পর্যন্ত তার মায়ের শরীর থেকে খাদ্য গ্রহণ করে থাকে। তাই শিশুদের এনিমিয়া বা রক্তশূন্যতার সাথে মায়েদের ভূমিকা পরিলক্ষিত। সাধারণত যেসব কারণে শিশুরা রক্তশূন্যতায় ভোগে তাহলোঃ-
- শিশু গর্ভাবস্থায় থাকা কালীন মায়েরা অপুষ্টিতে ভোগা।
- গর্ভকালীন অবস্থায় রক্তক্ষরণ।
- নির্দিষ্ট সময়ের পূর্বে গর্ভপাত হওয়া।
- জন্মের পর শিশুর ওজন কম হওয়া।
শিশুকে জন্মের ছয় মাস বয়স পর্যন্ত মায়ের দুধ পান না করানো। ছয় মাসের পর বুকের দুধের পাশাপাশি অন্যান্য পুষ্টিকর খাবার না খাওয়ানো। ইত্যাদি
রক্তস্বল্পতা এড়াতে শিশুকে যা খাওয়াবেন
আপনার শিশুকে সুস্থ্য রাখতে পুষ্টিকর খাদ্যের বিকল্প নেই। শিশু জন্মের ছয় মাস পর থেকে মায়ের দুধের পাশাপাশি অন্যান্য ভিটামিন যুক্ত খাবার খাওয়ানোর চেষ্টা করুন যেমন: খিচুড়ি, মাছ, মাংস, কলিজা, শাক-সবজি ফলমূল ইত্যাদি।
থ্যালাসেমিয়া বংশগত বা বংশানুক্রমিকভাবে রক্তশূন্যতা
অনেক সময় বংশগত কারণেও এনিমিয়া বা রক্তস্বল্পতা সমস্যা দেখা যায়। থ্যালাসেমিয়ার কারণে রক্তের লোহিত কণিকার পরিমাণ কম হয়। অনেক সময় থ্যালাসেমিয়ার প্রভাবে রক্তে লোহিত কণিকার আয়ুস্কাল কমে যায় ফলে রক্তকণিকা গুলো খুব দ্রুত ভেঙে যায়।
শরীরের হিমোগ্লোবিনের অভাব দেখা দেয়। যা থেকে তৈরি হয় এনিমিয়া বা রক্তশূন্যতা। রক্তস্বল্পতা শিশুর স্বাভাবিক বৃদ্ধিতে বাধা দেয় যার ফলে মুখমণ্ডলে পরিবর্তণ এমনকি লিভার বড় হয়ে যাওয়ার মতো সমস্যা দেখা দিতে পারে।
হুকওয়ার্ম থেকে রক্তশূন্যতা
কৃমির মাধ্যমে যে এনিমিয়া বা রক্তস্বল্পতা দেখা দেয় ডাক্তারদের ভাষায় সেটাকে হুকওয়ার্ম বলা হয়। হুকওয়ার্মের আক্রমণের কারণে অন্ত্রের রক্তক্ষরণ হয় ফলে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা কমে যায়। যা থেকে দেখা দিতে পারে রক্তশূন্যতা। বিশেষজ্ঞদের মতে খোলা জায়গায় পায়খানা করা বা খালি পায়ে পায়খানার সংস্পর্শ আসার কারণে দেহে হুকওয়ার্ম কৃমি প্রবেশ করে।
শেষ কথাঃ
এনিমিয়া বা রক্তশূন্যতা আমাদের খাদ্যের সাথে জড়িত। তাই প্রতিদিন নিয়ম মেনে পুষ্টিকর খাবার খাওয়ার চেষ্টা করুন। সাধ্যের বাহিরে না গিয়ে সাধ্যের মধ্যে থাকা শাক-সবজি ও ফলমূল খেতে পারেন। মোট কথা শরীরকে সুস্থ্য রাখতে সুষম খাবার খাওয়ার বিকল্প নেই।
আরো জানুনঃ
ডেঙ্গু রোগের লক্ষণ কি? ডেঙ্গু রোগ থেকে বাঁচার উপায়।