জাপান স্কিলড ওয়ার্কার ভিসা,আবেদন,যোগ্যতা,খরচ ২০২৫
আমাদের দেশের অনেক তরুণদের স্বপ্ন বিদেশে কাজ করে উপার্জন করা। বাংলাদেশ,ভারত,নেপাল,দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মানুষ বিদেশে কাজ করে আয়ের পাশাপাশি উন্নত জীবন যাপন করতে চান। জাপান হলো বিশ্বের অন্যতম ধনী ও প্রযুক্তিগতভাবে খুবই উন্নত দেশ। আর এর কারনে বিশ্বের অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের মানুষেরা সেখানে বিভিন্ন ভিসাতে গিয়ে কাজ করে টাকা উপার্জন করতে চায়।
যদিও জাপান একটি ধনী রাষ্ট্র কিন্তু দিন দিন এর জনসংখ্যা কমে যাচ্ছে।আর এরই কারণে উৎপাদন, নার্সিং কেয়ার,কৃষিকাজ,নির্মাণের শ্রমিক ইত্যাদি জনবল দিন দিন ঘাটতি দেখা দিচ্ছে।এই ঘাটতিপুরণ করার লক্ষ্যে বর্তমানে জাপান সরকার জাপান স্কিলড ওয়ার্কার ভিসা নামক একটি ভিসা চালু করেছে।
এই ভিসার মাধ্যমে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে দক্ষ কর্মী নিয়োগ করে বিভিন্ন কাজ করার সুযোগ করে দিচ্ছে। এই পোস্টে আমি আপনাদেরকে বিস্তরভাবে জানাবো- জাপান স্কিলড ওয়ার্কার ভিসা কি, এর বিভিন্ন ধরণ, জাপান স্কিল ওয়ার্কার ভিসার আবেদন প্রক্রিয়া,যোগ্যতা,প্রয়োজনীয় ডকুমেন্টস, ভিসার খরচ,বেতন এবং বিভিন্ন সুবিধা ও চ্যালেঞ্জ। তো প্রথমে জেনে নেই জাপান স্কিলড ওয়ার্কার ভিসা কী?
জাপান স্কিলড ওয়ার্কার ভিসা কী?
জাপান স্কিলড ওয়ার্কার ভিসা একটি বিশেষ ওয়ার্ক পারমিট ভিসা। ২০১৯ সালে প্রথমে চালু করা হয়। এ ভিসার মূল উদ্দেশ্য হলো, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে দক্ষ কর্মী এনে জাপানের বিভিন্ন খাতে কর্মীর সংকট পূরণ করা। এই ভিসার জন্য যদি আপনি আবেদন করেন, তাহলে অবশ্যই আপনাকে কোন একটি নির্দিষ্ট সেক্টরে দক্ষতা অর্জন করতে হবে এবং প্রাথমিকভাবে জাপানি ভাষা পরিক্ষায় পাশ করতে হবে।
স্কিলড ওয়ার্কার ভিসার ধরণ
জাপান স্কিলড ওয়ার্কার ভিসা সাধারণত দুই ধরনের। যথা-
Type 1 Specified Skill Worker (SSW): এই ভিসায় আপনি সর্বোচ্চ জাপানে পাঁচ বছর পর্যন্ত কাজ করার অনুমতি পাবেন। অবশ্যই এক্ষেত্রে প্রাথমিক দক্ষতা পরীক্ষায় আপনাকে পাস করতে হবে। ১২টি সেক্টরে কাজ করার সুযোগ পাবেন কিন্তু পরিবারকে সঙ্গে নেয়া যাবে না।
Type 2 Specified Skill Worker (SSW): এই ভিসায় জাপানে আপনি দীর্ঘ মেয়াদে কাজ করতে পারবেন এবং স্থায়ীভাবে বসবাসের সুযোগ পাবেন। আপনাকে অবশ্যই উচ্চপর্যায়ে দক্ষতা অর্জন করতে হবে। সীমিত সংখ্যক সেক্টরে আপনি কাজ করার সুযোগ পাবেন এবং আপনার পরিবারকে সঙ্গে নিয়ে যেতে পারেন।জেনে রাখা ভালো যে, সাধারণত প্রথমে আপনাকে SSW 1 ভিসা দেয়া হবে। নির্দিষ্ট অভিজ্ঞতা অর্জনের পর আপনি SSW 2 ভিসাতে রুপান্তরিত করতে পারবেন।
ওয়ার্কার ভিসায় কোন কোন সেক্টরে কাজের সুযোগ পাওয়া যায়?
জাপান স্কিল ওয়ার্কার ভিসার আওতায় মোট ১৪ টি সেক্টরে আপনি কাজ করার সুযোগ পাবেন। এই সেক্টরগুলোর মধ্যে নার্সিং,কেয়ার,নির্মাণ,কৃষি ও খাদ্যশিল্পের সবচেয়ে বেশি কর্মীর চাহিদা সেখানে রয়েছে। সেক্টরগুলো হলো-
- নার্সিং কেয়ার।
- বিল্ডিং ক্লিনিং।
- ম্যানুফ্যাকচারিং।
- ইলেকট্রনিক্স ও মেশিনারি।
- কনস্ট্রাকশন।
- মেরিন ইন্ডাস্ট্রি।
- কৃষি বা এগ্রিকালচার।
- ফুট প্রসেসিং।
- গাড়ি শিল্প।
- হোটেল ও আতিথেয়তা।
- এভিয়েশন সেক্টর।
- লজিস্টিকস।
- ফুড এন্ড বেভারেজ সার্ভিস।
- মৎস্য শিল্প।
জাপান স্কিলড ওয়ার্কার ভিসার যোগ্যতা
জাপান স্কিলড ওয়ার্কার ভিসাতে জাপানে যেতে হলে আপনাকে অবশ্যই কিছু যোগ্যতা পূরণ করতে হবে। যোগ্যতাগুলো নিম্নরূপ-
- স্কিলড টেস্ট এ পাস করতে হবে অর্থাৎ আপনার নির্বাচিত সেক্টরে আপনার কাজের দক্ষতার প্রমাণ করতে হবে।
- জাপানি ভাষা দক্ষতায় আপনাকে অবশ্যই পাশ করতে হবে। কেননা, দৈনন্দিন কাজে তাদের ভাষা বুঝতে হবে এবং বলতে হবে। এক্ষেত্রে JLPT N4 অথবা সমমানের NAT পরীক্ষায় আপনাকে পাস করতে হবে।
- শিক্ষাগত যোগ্যতার ক্ষেত্রে এসএসসি /এইচএসসি পাশ থাকলে আবেদন করতে পারবেন।কিছু ক্ষেত্রে ডিপ্লোমা বা বিশেষ কোর্স করা থাকলে বাড়তি সুযোগ পাওয়ার সম্ভাবনা আছে।
- শারীরিকভাবে সুস্থ থাকতে হবে।
কেন জাপান স্কিলড ওয়ার্কার ভিসা জনপ্রিয়?
- নিরাপদ কাজের পরিবেশ ও শান্তিপূর্ণ দেশ জাপান।
- উচ্চমানের প্রযুক্তি ও কাজের সুব্যবস্থা রয়েছে।
- দীর্ঘমেয়াদি ক্যারিয়ার গড়ার সুযোগ আছে।
- স্থায়ীভাবে বসবাস করার সুযোগ সেখানে রয়েছে।
- আন্তর্জাতিক মানের অভিজ্ঞতা অর্জন করা যায়, ইত্যাদি।
জাপান স্কিলড ওয়ার্কার ভিসার জন্য প্রয়োজনীয় ডকুমেন্ট
ভিসা পাওয়ার ক্ষেত্রে আপনাকে অবশ্যই কিছু প্রয়োজনীয় ডকুমেন্টস লাগবে। যে ডকুমেন্টগুলো লাগবে তা হল-
- বৈধ একটি পাসপোর্ট।
- পাসপোর্ট সাইজের ছবি (সদ্য তোলা)।
- শিক্ষাগত যোগ্যতার সনদপত্র।
- দক্ষতা পরীক্ষার সার্টিফিকেট।
- চাকরির অফার লেটার।
- পুলিশ ক্লিয়ারেন্স সার্টিফিকেট।
- মেডিকেল সনদ।
- JLPT/NAT পরীক্ষার সনদপত্র।
জাপান স্কিলড ওয়ার্কার ভিসার খরচ
এই ভিসা পেতে আপনাকে অবশ্যই নিচের দেয়া খরচ গুলো করতে হবে।
- দক্ষতা পরীক্ষার ফি বাবদ আপনাকে বাংলাদেশী টাকায় প্রায় ৩৫০০ থেকে ৭০০০ টাকা দিতে হবে।
- ভাষা পরীক্ষার ফি বাবদ দিতে হবে বাংলাদেশী টাকায় ৫০০০ থেকে ৮০০০ টাকা।
- ভিসা ফি বাবদ জমা দিতে হবে প্রায় ২৫০০ থেকে ৫০০০ টাকা।এছাড়া মেডিকেল টেস্ট ও কাগজপত্র বাবদ খরচ হবে আরো প্রায় ১৫ হাজার থেকে ২৫ হাজার টাকা।
- সব মিলিয়ে ৫০০০০ থেকে ৮০০০০ ইয়েন বা বাংলাদেশি টাকায় আনুমানিক ৪০ হাজার থেকে ৬০ হাজার টাকা খরচ হতে পারে।
ভিসার মেয়াদ ও বেতন
এই ভিসার মেয়াদ সাধারণত প্রথমে ১ বছর থেকে ৫ বছর পর্যন্ত দিয়ে থাকে। বেতনের ক্ষেত্রে গড়ে মাসিক ১.৫ লক্ষ থেকে ২.৫ লক্ষ ইয়েন যেটা বাংলাদেশি টাকায় ১ থেকে ২ লক্ষ টাকার মতো। তবে ওভারটাইম করলে আপনি বাড়তি বেতন পাবেন।
স্কিলড ওয়ার্কার ভিসার সুবিধা সমূহ
এই ভিসার কিছু সুবিধা রয়েছে। সুবিধাগুলো নিম্নরূপ-
- বৈধভাবে জাপানে গিয়ে কাজ করার সুযোগ।
- বেতন বেশি ও নিরাপদ জীবনযাত্রা।
- স্থায়ীভাবে বসবাসের সুযোগ যেটি SSW-2 ভিসাতে রয়েছে।
- পরিবারকে সঙ্গে নেয়ার সুযোগ (SSW-2 ভিসাতে)।
- আন্তর্জাতিকভাবে কাজের অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারবেন।
- উন্নত স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষা সুবিধাটাও পাবেন।
- সর্বোপরি জাপান ঘোরার সুযোগ পাবেন।
স্কিলড ওয়ার্কার ভিসার অসুবিধা
জাপান স্কিলড ওয়ার্কার ভিসাতে যথেষ্ট পরিমাণ সুবিধা থাকলেও কিছু অসুবিধা রয়েছে।অসুবিধা গুলো হলো-
- আপনাকে জাপানি ভাষা শিখতে হবে এটা বাধ্যতামূলক।
- প্রথম ভিসাতে আপনি আপনার পরিবারকে নিয়ে যেতে পারবেন না।
- জাপানিজ সংস্কৃতির সাথে মানিয়ে নেওয়াটা কিছুটা কঠিন।
- কাজের পরিবেশ অনেক সময় একটু কঠিন হয়ে পড়ে।
- জাপানে কাজের চাপ বেশি এবং সুশৃংখলভাবে বসবাস করতে হবে।
জাপান স্কিলড ওয়ার্কার ভিসা আবেদন করার নিয়ম
জাপান স্কিলড ওয়ার্কার ভিসা আবেদন করার পূর্বে প্রথমে আপনাকে জাপানি ভাষা শেখা এবং আপনি যে সেক্টরে কাজ করতে চান সেই সেক্টরের কাজের দক্ষতা অর্জন করতে হবে। এরপর নির্দিষ্ট দক্ষতার পরীক্ষায় ও ভাষা পরীক্ষায় আপনাকে পাস করতে হবে।জাপানি কোন নির্ভরযোগ্য কোম্পানির কাছ থেকে চাকরির অফার লেটার সংগ্রহ করতে হবে।
এরপর উপরে উল্লেখিত সকল ডকুমেন্টস সংগ্রহ করে কোন অনুমোদিত এজেন্সির মাধ্যমে জাপান এম্বাসি বা কনস্যুলেটে সব নিয়ম মেনে জমা দিতে হবে।আপনার প্রদত্ত সকল ডকুমেন্টস যাচাই করার পর অনুমোদন হলে, আপনি এই ভিসাতে খুব সহজেই জাপানে যেতে পারবেন।
বাংলাদেশী কর্মীদের জন্য সুযোগ
বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর হাজার হাজার লোক বিভিন্ন ভিসায় জাপানে কাজ করতে যাচ্ছেন। বাংলাদেশ সরকার জাপানের সাথে ইতিমধ্যে TIPT চালু করেছে। যার ফলশ্রুতিতে, বাংলাদেশের দক্ষ কর্মীরা খুব সহজে জাপানে চাকরি/কাজ করার সুযোগ পাচ্ছেন।
ভিসা পাওয়ার প্রস্তুতি
- জাপানি ভাষা শিখুন, যাতে সেখানে সঠিকভাবে তথ্যাদান প্রদান করতে পারবেন।
- নির্বাচিত সেক্টরে কাজের দক্ষতা অর্জনের জন্য ট্রেনিং নিন।
- প্রতারণায এড়াতে অনুমোদিত এজেন্সির মাধ্যমে সকল কাজ সম্পন্ন করুন।
- সব ডকুমেন্টস সঠিক ভাবে প্রস্তুত করুন।
- ভিসা প্রক্রিয়ায় কিছুটা দেরি হতে পারে, তাই ধৈর্য ধরুন।
শেষ কথা
জাপান স্কিলড ওয়ার্ক ভিসা হলো দক্ষ কর্মীদের জন্য অসাধারণ এক সুযোগ। জাপান ভাষায় জ্ঞান অর্জন করে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সংগ্রহ এবং আপনার পছন্দের সেক্টরের দক্ষতা অর্জন করে সহজেই এই ভিসা পাওয়া সম্ভব। তাই দেরি না করে এখনই প্রস্তুতি নিন, সঠিক নিয়মে আবেদন করুন। ভিসা পেয়ে জাপানে কাজে যোগদান করে আপনার এবং আপনার পরিবারের আর্থিক অবস্থা মজবুত করুন।
জাপান স্কিলড ওয়ার্কার ভিসা সম্পর্কিত প্রশ্নোত্তর। FAQ
১। SSW Type 1 আর SSW Type 2 এর মধ্যে পার্থক্য কী?
উত্তর-SSW 1 ভিসায় জাপানে পাঁচ বছর পর্যন্ত কাজ করা যায় কিন্তু পরিবার নেওয়া যায় না। অপেরদিকে SSW 2 ভিসাতে স্থায়ীভাবে বসবাস করা যায় ও পরিবার নিয়ে যাওয়া যায়।
২। জাপানি স্কিলড ওয়ার্কার ভিসার জন্য কি জাপানি জানা ভাষা বাধ্যতামূলক?
উত্তর-হ্যাঁ,আপনাকে ভাষা জানতে হবে। সর্বনিন্ম JLPT N4 বা সমমানের NAT পরীক্ষায় পাশ করতে হবে।
৩। জাপানের সর্বনিম্ন বেতন কত?
উত্তর-অঞ্চল ভেদে জাপানের সর্বনিম্ন বেতন ভিন্ন হয়ে থাকে। তবে ২০২৫ সালের হিসাব অনুযায়ী ঘন্টা প্রতি নূন্যতম বেতন ৯৬০ ইয়েন থেকে ১১০০ ইয়েন।
৪। SSW-1 থেকে SSW-2 এ পরিবর্তন করা যায় কিভাবে?
উত্তর-হ্যাঁ এটা পরিবর্তন করা যায়। নির্দিষ্ট সময় ধরে জাপানে কাজের অভিজ্ঞতা অর্জন করতে হবে। উচ্চ দক্ষতা পরীক্ষায় পাশ করতে হবে।
৫। জাপানের ভিসা কিভাবে পাওয়া যাবে?
উত্তর-প্রথমে জাপানি ভাষা ও দক্ষতা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হবে। জাপানি কোম্পানি থেকে জব লেটার নিতে হবে। প্রয়োজনীয় সকল ডকুমেন্টস প্রস্তুত করে জাপান এম্বাসি বা কনস্যুলেটে আবেদন করতে হবে।
৬। বাংলাদেশ থেকে জাপানে যাওয়া কতটা সহজ ?
উত্তর-ভাষা ও দক্ষতা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে সঠিক এজেন্সির মাধ্যমে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সহ আবেদন করলে জাপানে যাওয়া সহজ হবে।
৭। এই ভিসায় কি জাপানে স্থায়ীভাবে থাকা যায়?
উত্তর-SSW-1 ভিসাতে থাকা যায় না, তবে SSW-2 ভিসায় দীর্ঘমেয়াদে থেকে স্থায়ী বসবাস করার সুযোগ পাওয়া যায়।
৮। জাপানি স্কিলড ওয়ার্কার ভিসার আবেদন কোথায় করতে হয়?
উত্তর- সকল কাগজপত্র সহ জাপান এম্বেসি/কনসুলেটে আপনার আবেদন জমা দিতে পারবেন।
আরো জানুনঃ
কম খরচে সরকারিভাবে জাপান যাওয়ার উপায়





